বুধবার, ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০০৯

স্বপ্ন

পাণ্ডুলিপি কাছে রেখে ধূসর দীপের কাছে আমি

নিস্তব্ধ ছিলাম ব’সে;

শিশির পড়িতেছিল ধীরে-ধীরে খ’সে;

নিমের শাখার থেকে একাকীতম কে পাখি নামি



উড়ে গেলো কুয়াশায়,- কুয়াশার থেকে দূর-কুয়াশায় আরো।

তাহারি পাখার হাওয়া প্রদীপ নিভায়ে গেলো বুঝি?

অন্ধকার হাতড়ায়ে ধীরে-ধীরে দেশলাই খুঁজি;

যখন জ্বলিবে আলো কার মুখ দেখা যাবে বলতে কি পারো?



কার মুখ?- আমলকী শাখার পিছনে

শিঙের মতন বাঁকা নীল চাঁদ একদিন দেখেছিলো, আহা,

সে-মুখ ধূসরতম আজ এই পৃথিবীর মনে।



তবু এই পৃথিবীর সব আলো একদিন নিভে গেলে পরে,

পৃথিবীর সব গল্প একদিন ফুরাবে যখন,

মানুষ র’বে না আর, র’বে শুধু মানুষের স্বপ্ন তখনঃ

সেই মুখ আর আমি র’বো সেই স্বপ্নের ভিতরে।

শব

যেখানে রূপালি জ্যোৎস্না ভিজিতেছে শরের ভিতর,

যেখানে অনেক মশা বানায়েছে তাহাদের ঘর;

যেখানে সোনালি মাছ খুঁটে-খুঁটে খায়

সেই সব নীল মশা মৌন আকাঙ্ক্ষায়?

নির্জন মাছের রঙে যেইখানে হ’য়ে আছে চুপ

পৃথিবীর একপাশে একাকী নদীর গাঢ় রূপ;

কান্তারের একপাশে যে-নদীর জল

বাবলা হোগলা কাশে শুয়ে-শুয়ে দেখিছে কেবল

বিকালের লাল মেঘ; নক্ষত্রের রাতের আঁধারে

বিরাট নীলাভ খোঁপা নিয়ে যেন নারী মাথা নাড়ে

পৃথিবীর অন্য নদী; কিন্তু এই নদী

রাঙা মেঘ- হ্লুদ-হলুদ জ্যোৎস্না; চেয়ে দ্যাখো যদি;

অন্য সব আলো আর অন্ধকার এখানে ফুরালো;

লাল নীল মাছ মেঘ- ম্লান নীল জ্যোৎস্নার আলো

এইখানে; এইখানে মৃণালিনী ঘোষালের শব

ভাসিতেছে চিরদিনঃ নীল লাল রূপালি নীরব।

শহর

হৃদয়, অনেক বড়ো-বড়ো শহর দেখেছো তুমি;

সেই সব শহরের ইটপাথর,

কথা, কাজ, আশা, নিরাশার ভয়াবহ হৃত চক্ষু

আমার মনের বিস্বাদের ভিতর পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।

কিন্তু তবুও শহরের বিপুল মেঘের কিনারে সূর্য উঠতে দেখেছি;

বন্দরের ওপারে সূর্যকে দেখেছি

মেঘের কমলারঙের ক্ষেতের ভিতর প্রণয়ী চাষার মতো বোঝা রয়েছে তার;

শহরের গ্যাসের আলো ও উঁচু-উঁচু মিনারের ওপরেও দেখেছি- নক্ষত্রেরা-

অজস্র বুনো হাঁসের মতো কোন দক্ষিণ সমুদ্রের দিকে উড়ে চলেছে।

শ্রাবণরাত

শ্রাবণের গভীর অন্ধকার রাতে

ধীরে ধীরে ঘুম ভেঙে যায়

কোথায় দূরে বঙ্গোপসাগরের শব্দ শুনে?

বর্ষণ অনেকক্ষণ হয় থেমে গেছে;

যত দূর চোখ যায় কালো আকাশ

মাটির শেষ তরঙ্গকে কোলে করে চুপ করে রয়েছে যেন;

নিস্তব্ধ হইয়ে দূর উপসাগরের ধ্বনি শুনছে।

মনে হয়

কারা যেন বড়ো-বড়ো কপাট খুলছে,

বন্দ করে ফেলেছে আবার;

কোন্‌ দূর- নীরব- আকাশরেখার সীমানায়।

বালিশের মাথা রেখে যারা ঘুমিয়ে আছে

তারা ঘুমিয়ে থাকে;

কাল ভোরে জাগাবার জন্য।

যে-সব ধূসর হাসি, গল্প, প্রেম, মধুরেখা

পৃথিবীর পাথরে কঙ্কালে অন্ধকারে মিশেছিলো

ধীরে-ধীরে জেগে ওঠে তারা;

পৃথিবীর অবিচলিত পঞ্জর থেকে খশিয়ে আমাকে খুঁজে বার করে।

সমস্ত বঙ্গোপসাগরের উচ্ছ্বাস থেমে যায় যেন;

মাইলের পর মাইল মৃত্তিকা নীরব হয়ে থাকে।

কে যেন বলেঃ

আমি যদি সেই সব কপাট স্পর্শ করতে পারতাম

তাহলে এই রকম গভীর নিস্তব্ধ রাতে স্পর্শ করতাম গিয়ে।

আমার কাঁধের উপর ঝাপসা হাত রেখে ধীরে-ধীরে আমাকে জাগিয়ে দিয়ে।

চোখ তুলে আমি

দুই স্তর অন্ধকারের ভিতর ধূসর মেঘের মতো প্রবেশ করলামঃ

সেই মুখের ভিতরে প্রবেশ করলাম।

ফিরে এসো

ফিরে এসো সমুদ্রের ধারে,

ফিরে এসো প্রান্তরের পথে;

যেইখানে ট্রেন এসে থামে

আম নিম ঝাউয়ের জগতে

ফিরে এসো; একদিন নীল ডিম করেছো বুনন;

আজো তারা শিশিরে নীরব;

পাখির ঝরণা হয়ে কবে

আমারে করিবে অনুভব!

সিন্ধুসারস

দু-এক মুহূর্তে শুধু রৌদ্রের সিন্ধুর কোলে তুমি আর আমি

হে সিন্ধুসারস,

মালাবার পাহাড়ের কোল ছেড়ে অতি দূর তরঙ্গের জানালায় নামি

নাচিতেছে টারান্‌টেলা- রহস্যের; আমি এই সমুদ্রের পারে চুপে থামি

চেয়ে দেখি বরফের মতো শাদা ডানা দু'টি আকাশের গায়

ধবল ফেনার মতো নেচে উঠে পৃথিবীরে আনন্দ জানায়।

মুছে যায় পাহাড়ের শিঙে-শিঙে গৃধিনীর অন্ধকার গান,

আবার ফুরায় রাত্রি, হতাশ্বাস; আবার তোমার গান করিছে নির্মাণ

নতুন সমুদ্র এক, শাদা রৌদ্র, সবুজ ঘাসের মতো প্রাণ

পৃথিবীর ক্লান্ত বুকে; আবার তোমার গান

শৈলের গহ্বর থেকে অন্ধকার তরঙ্গেরে করিছে আহ্বান।

জানো লি অনেক যুগ চলে গেছে? মরে গেছে অনেক নৃপতি?

অনেক সোনার ধার ঝরে গেছে জানো না কি? অনেক গহন ক্ষতি

আমাদের ক্লান্ত করে দিয়ে গেছে- হারায়েছি আনন্দের গতি;

ইচ্ছা, ছিন্তা, স্বপ্ন, ব্যথা, ভবিষ্যৎ, বর্তমান- এই বর্তমান

হৃদয়ে বিরস গান গাহিতেছে আমাদের- বেদনার আমার সন্তান?


জানি পাখি, শাদা পাখি, মালাবার ফেলার সন্তান,

তুমি পিছে চাহো নাকো, তোমার অতীত নেই, স্মৃতি নেই,

বুকে নেই আকীর্ণ ধূসর

পাণ্ডুলিপি; পৃথিবীর পাখিদের মতো নেই শীতরাতে

ব্যথা আর কুয়াশার ঘর।

যে-রক্ত ঝরেছে তারে স্বপ্নে বেঁধে কল্পণার নিঃসঙ্গ প্রভাত

নেই তব; নেই নিম্নভূমি- নেই আনন্দের অন্তরালে

প্রশ্ন আর চিন্তার আঘাত।


স্বপ্ন তুমি দ্যাখোনি তো- পৃথিবীর সব পথ সব সিন্ধু ছেড়ে দিয়ে একা

বিপরীত দ্বীপে দূরে মায়াবীর আরশিতে হয় শুধু দেখা

রূপসীর সাথে এক; সন্ধ্যার নদীর ঢেউয়ে আসন্ন গল্পের মতো রেখা

প্রাণে তার- ম্লান চুল, চোখ তার হিজল বনের মতো কালো;

একবার স্বপনে তারে দেখে ফেলে পৃথিবীর সব স্পষ্ট আলো


নিভে গেছে যেখানে সোনার মধু ফুরায়েছে, করে না বুনন

মাছি আর; হলুদ পাতার গন্ধে ভরে ওঠে শালিকের মন,

মেঘের দুপুর ভাসে- সোনালি চিলের বুক হয় উন্মন

মেঘের দুপুরে, তাহা, ধানসিঁড়ি নদীটির পাশে;

সেখানে আকাশে কেউ নেই আর, নেই আর পৃথিবীর ঘাসে।

তুমি সেই নিস্তব্ধতা চেনো নাকো; অথাবা রক্তের পথে

পৃথিবীর ধূলির ভিতরে

জানো নাকো আজো কাঞ্চী বিদিশার মুখশ্রী মাছির মতো ঝরে;

সৌন্দর্য রাখিছে হাত অন্ধকার ক্ষুধার বিবরে;

গভীর নীলাভতম ইচ্ছা চেষ্টা মানুষের- ইন্দ্রধনূ ধরিবার ক্লান্ত আয়োজন

হেমন্তের কুয়াশায় ফুরাতেছে অল্পপ্রাণ দিনের মতন।


এইসব জানো নাকো প্রবালপঞ্জর ঘিরে ডাজান উল্লাসে;

রৌদ্রে ঝিলমিল করে শাদা ডানা শাদা ফেনা- শিশুদের পাশে

হেলিওট্রোপের মতো দুপুরের অসীম আকাশ!

ঝিকমিক করে রৌদ্রের বরফের মতো শাদা ডানা,

যদিও এ-পৃথিবীর স্বপ্ন ছিন্তা সব তার অচেনা অজানা।

চঞ্চল শরের নীড়ে কবে তুমি- জম্ন তুমি নিয়েছিলে কবে,

বিষণ্ণ পৃথিবী ছেড়ে দলে-দলে নেমেছিলে সবে

আরব সমুদ্রে, আর চীনের সাগরে- দূর ভারতের সিন্ধুর উৎসবে।

শীতার্ত এ-পৃথিবীর আমরণ চেষ্টা ক্লান্তি বিহ্বলতা ছিঁড়ে

নেমেছিলে কবে নীল সমুদ্রের নীড়ে।

ধানের রসের গল্প পৃথিবীর- পৃথিবীর নরম অঘ্রাণ

পৃথিবীর শঙ্খমালা নারী সেই- আর তার প্রেমিকের ম্লান

নিঃসঙ্গ মুখের রূপ, বিশুষ্ক তৃণের মতো প্রাণ,

জানিবে না, কোনোদিন জানিবে না; কলরব করে উড়ে যায়

শত স্নিগ্ধ সূর্য ওরা শাশ্বত সূর্যের তীব্রতায়।

নিরালোক

একবার নক্ষত্রের দিকে চাই- একবার প্রান্তরের দিকে

আমি অনিমিখে।

ধানের ক্ষেতের গন্ধ মুছে গেছে কবে

জীবনের থেকে যেন; প্রান্তরের মতন নীরবে

বিচ্ছিন্ন খড়ের বোঝা বুকে নিয়ে ঘুম পায় তার;

নক্ষত্রেরা বাতি জ্বেলে- জ্বেলে- জ্বেলে- নিভে গেলে- নিভে গেলে?

লে তারে জাগায় আবার;

জাগায় আবার।

বিক্ষত খড়ের বোঝা বুকে নিয়ে- বুকে নিয়ে ঘুম পায় তার,

ঘুম পায় তার।

অনেক নক্ষত্রে ভরে গেছে এই সন্ধ্যার আকাশ- এই রাতের আকাশ;

এইখানে ফাল্গুনের ছায়ামাখা ঘাসে শুয়ে আছি;

এখন মরণ ভালো,- শরীরে লাগিয়া রবে এই সব ঘাস;

অনেক নক্ষত্র রবে চিরকাল যেন কাছাকাছি।

কে যেন উঠিল হেঁচে,- হামিদের মরখুটে কানা ঘোড়া বুঝি!

সারাদিন গড়ি-টানা হলো ঢের,- ছুটি পেয়ে জ্যোৎস্নায় নিজ মনে খেয়ে যায় ঘাস,

যেন কোন ব্যথা নাই পৃথিবীতে,- আমি কেন তবে মৃত্যু খুঁজি?

কেন মৃত্যু খুঁজো তুমি? চাপা ঠোঁটে বলে দূর কৌতুকী আকাশ।

ঝাউফলে ঘাস ভরে- এখানে ঝাউয়ের নিচে শুয়ে আছি ঘাসের উপরে;

কাশ আর চোরাকাঁটা ছেড়ে দিয়ে ফড়িং চলিয়া গেছে ঘরে।

সন্ধ্যার নক্ষত্র, তুমি বলো দেখি কোন্‌ পথে কোন্‌ ঘরে যাবো!

কোথায় উদ্যম নাই, কোথায় আবেগ নাই,- চিন্তা স্বপ্ন ভুলে গিয়ে

শান্তি আমি পাবো?

রাতের নক্ষত্র, তুমি বলো দেখি কোন্‌ পথে যাবো?

তোমারি নিজের ঘরে চলে যাও- বলিল নক্ষত্র চুপে হেসে-

অথবা ঘাসের পরে শুয়ে থাকো আমার মুখের রূপ ঠায় ভালোবেসে;

অথবা তাকায়ে দ্যাখো গরুর গাড়িটি ধীরে চলে যায় অন্ধকারে

সোনালি খড়ের বোঝা বুকে;

পিছে তার সাপের খোলশ, নালা, খলখল অন্ধকার- শান্তি তার

রয়েছে সমুখে;

লে যায় চুপে-চুপে সোনালি খড়ের বোঝা বুকে;-

যদিও মরেছে ঢের গন্ধর্ব, কিন্নর, যক্ষ,- তবু তার মৃত্যু নাই মুখে।